বৈদেশিক আয়ের উপর আয়কর

বৈদেশিক আয়ের উপর আয়কর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

বাংলাদেশের বর্তমান কর কাঠামোতে বৈদেশিক আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বায়নের যুগে ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িকভাবে বৈদেশিক আয়ের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, বৈদেশিক আয়ের উপর কর প্রযোজ্যতা, করমুক্তির সুযোগ এবং কর নীতির পরিষ্কার ধারণা প্রদান করা আয়কর আইন ২০২৩-এর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এখানে আমরা বৈদেশিক আয়ের উপর বাংলাদেশ আয়কর আইন ২০২৩-এর আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

১.বৈদেশিক আয়ের সংজ্ঞা:

বৈদেশিক আয় বলতে বোঝানো হয় সেই সকল আয়, যা বাংলাদেশ সীমার বাইরে উৎপন্ন হয়েছে। এটি ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। বৈদেশিক আয়ের উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বিদেশি কোম্পানির শেয়ার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ, বিদেশে বিনিয়োগকৃত সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয় ইত্যাদি।

২.বাংলাদেশে আয়কর দায়িত্ব:

বাংলাদেশের আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, একজন বাসিন্দা (resident)বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সার্বিক বৈদেশিক আয় (global income)করযোগ্য বলে গণ্য করা হবে। এর অর্থ হলো, একজন ব্যক্তি যদি বৈদেশিক আয় পান এবং তিনি বাংলাদেশের ট্যাক্স রেসিডেন্ট হন, তবে সেই আয় বাংলাদেশে করযোগ্য হবে।

৩.বৈদেশিক আয়ের উপর করের হার:

ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক উভয় বৈদেশিক আয় বাংলাদেশে করের আওতায় পড়ে। ব্যক্তি পর্যায়ে, বৈদেশিক আয়ের উপর ব্যক্তির আয়কর স্তর অনুযায়ী কর ধার্য হবে। তবে ব্যবসায়িক আয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানি করের নির্ধারিত হার প্রযোজ্য হবে, যা সাধারণত ৩০%।

৪.রেমিট্যান্স এবং কর মওকুফ:

বাংলাদেশ সরকার বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে বিশেষ কর সুবিধা প্রদান করে থাকে। রেমিট্যান্স করমুক্ত থাকে, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে পাঠানো টাকা আয়কর মওকুফ করা হয়েছে। তবে যদি রেমিট্যান্সের অর্থ বাংলাদেশে পুনর্বিনিয়োগ করা হয় এবং সেই বিনিয়োগ থেকে আয় উৎপন্ন হয়, তাহলে সেই আয় করযোগ্য হতে পারে।

৫.দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (Double Tax Avoidance Agreement – DTAA):

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (DTAA) েরয়েছে, যার মাধ্যমে এক ব্যক্তির বৈদেশিক আয়ের উপর দুই দেশে কর না দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে, একজন ব্যক্তি যিনি একটি বিদেশি দেশে কর দেন, বাংলাদেশে সেই আয়ের জন্য আবার কর দিতে হবে না। DTAA-এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কর সুবিধা সমন্বিত হয়, যা করদাতার উপর করের বোঝা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের সাথে দ্বৈত করারোপন পরিহার চুক্তির আওতায় যে ৪০ টি দেশ রয়েছে তাদের তালিকা নিম্নরূপ;

১. বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম
২. বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র
৩. বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য
৪. বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত
৫. বাংলাদেশ ও তুরস্ক
৬. বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড
৭. বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড
৮. বাংলাদেশ ও সুইডেন
৯. বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা
১০. বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া
১১. বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর
১২. বাংলাদেশ ও রোমানিয়া
১৩. বাংলাদেশ ও ওমান
১৪. বাংলাদেশ ও পোল্যান্ড
১৫. বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন
১৬. বাংলাদেশ ও পাকিস্তান
১৭. বাংলাদেশ ও নরওয়ে
১৮. বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস
১৯. বাংলাদেশ ও নেপাল
২০. বাংলাদেশ ও মিয়ানমার
২১. বাংলাদেশ ও মরক্কো
২২. বাংলাদেশ ও মরিশাস
২৩. বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ
২৪. বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া
২৫. বাংলাদেশ ও কুয়েত
২৬. বাংলাদেশ ও সৌদি আরব
২৭. বাংলাদেশ ও জাপান
২৮. বাংলাদেশ ও ইতালি
২৯. বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া
৩০. বাংলাদেশ ও ভারত
৩১. বাংলাদেশ ও জার্মানি
৩২. বাংলাদেশ ও ফ্রান্স
৩৩. বাংলাদেশ ও ডেনমার্ক
৩৪. বাংলাদেশ ও চেক প্রজাতন্ত্র
৩৫. বাংলাদেশ ও চীন
৩৬. বাংলাদেশ ও কানাডা
৩৭. বাংলাদেশ ও ভুটান
৩৮. বাংলাদেশ ও বেলজিয়াম
৩৯. বাংলাদেশ ও বেলারুস
৪০. বাংলাদেশ ও বাহরাইন

৬. বিদেশে প্রাপ্ত লভ্যাংশ ও সুদের কর:

যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশে শেয়ার বা বন্ড বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করেন, যেমন লভ্যাংশ বা সুদ, তবে সেই আয়ও বাংলাদেশে করযোগ্য হবে। বাংলাদেশ আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, বিদেশি শেয়ারের লভ্যাংশ এবং সুদ আয়ের উপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বা কোম্পানির করহার প্রযোজ্য হবে।

৭.বিদেশে বিনিয়োগ ও কর নিরীক্ষা:

বৈদেশিক আয়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই বিদেশে বিনিয়োগ একটি বড় বিষয় হয়ে দাড়ায়। বাংলাদেশ আয়কর আইন ২০২৩ এর আলোকে, বাংলাদেশি নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেন, তাদের বৈদেশিক সম্পত্তির উপর পূর্ণাঙ্গ কর নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। এই ক্ষেত্রে করদাতাকে যথাযথ দলিলাদি সরবরাহ করতে হবে এবং বিদেশে বিনিয়োগের উৎস সম্পর্কে কর কর্তৃপক্ষকে তথ্য প্রদান করতে হবে।

৮.কর ফাঁকি ও শাস্তি:

যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক আয়ের সঠিক তথ্য গোপন করে কিংবা কর প্রদান না করেন, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আয়কর আইন ২০২৩ এর আওতায় কর ফাঁকির অপরাধ প্রমাণিত হলে জরিমানা এবং শাস্তি প্রযোজ্য হতে পারে, যা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

৯.ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে বৈদেশিক আয় প্রদর্শন:

প্রত্যেক করদাতাকে তার আয়কর রিটার্নে বৈদেশিক আয়ের বিস্তারিত প্রদর্শন করতে হবে। বৈদেশিক আয়ের উৎস, আয়ের পরিমাণ, করের হার ইত্যাদি তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিলে ভুল বা তথ্য গোপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে।

১০.উন্নয়নশীল দৃষ্টিকোণ:

বৈদেশিক আয়ের উপর সুষ্ঠু কর ব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। বৈদেশিক আয়ের করযোগ্যতা এবং কর মওকুফের নীতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক। রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বিদেশি আয়ের সুষ্ঠু পরিচালনা করে সরকার দেশের আয়কর কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছে।

উপসংহার:

বাংলাদেশ আয়কর আইন ২০২৩-এর আলোকে বৈদেশিক আয় একটি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আইনের মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ের সঠিক তথ্য উপস্থাপন এবং কর প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। একইসাথে, করদাতাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন কর সুবিধা, যা বৈদেশিক আয়ের ক্ষেত্রে করের বোঝা কমায় এবং কর ফাঁকি প্রতিরোধ করে।

ekta cover lagbe

Recent Posts
Popular Posts

Book A free Consultation

Call us +8801787-696522 or fill out the form below to receive a free and confidential initial consultation.

Click To Contact
Dr. Gazi & Associates
Hello!
Get the best lawyer for any kind of solution for you.